পিটিয়ে মারার দৃশ্য দেখল শত শত মানুষ, কিছুই বলল না কেউ
থেমে গেছে কোলাহল। স্তব্ধ হয়ে গেছে পরিবারের সব হাসি-খুশি। ঈদের আনন্দ রূপ নিয়েছে বিষাদে। বাড়িজুড়ে কান্না আর আহাজারি। শোকে-ক্ষোভে বিহ্বল স্বজনরা। সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় মা-বাবা। শোকের ছায়া নেমেছে গ্রামজুড়ে।
মেঘনা নদীবেষ্টিত চরঞ্চল নরসিংদী সদর উপজেলার চরাঞ্চল কালাই গোবিন্দপুর গ্রামের দৃশ্য এটি। এই গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্র অনিককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে শত শত মানুষের সামনে পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলল সহপাঠীরা। পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই ভিডিও ভাইরাল হলে এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
তুচ্ছ ঘটনার জেরে মঙ্গলবার (০৪ আগস্ট) সন্ধ্যা ৬টার দিকে সদর উপজেলার নাগরিয়াকান্দি এলাকায় অনিককে পিটিয়ে হত্যা করে সহপাঠীরা। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার পর তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, সোমবার (০৩ আগস্ট) সদর উপজেলার নাগরিয়াকান্দি এলাকায় শেখ হাসিনা সেতুতে বেড়াতে যায় কালাই গোবিন্দপুর গ্রামের শহিদুল্লাহ মিয়ার ছেলে সাটিরপাড়া কালিকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ফারহান আহমেদ ওরফে অনিক (১৫)। ওই সময় তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দড়ি নবীপুর গ্রামের আজিজুল, শ্রাবণ, আরিফ ও মাইন উদ্দিনের সঙ্গে ঝগড়া হয় তার। পরে আশপাশের লোকজন তাদের নিভৃত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
পরদিন বিকেলে আজিজুল, শ্রাবণ, আরিফ, মাইন উদ্দিন, ইয়াসিন, সাগর ও বাদশাসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী নৌকাযোগে পিকনিক করতে নাগরিয়াকান্দি এলাকার শেখ হাসিনা সেতুতে আসে। বিকেল ৪টার দিকে অনিকের বন্ধু আরিফ ফোন করে তাকে সেতু এলাকায় আসতে বলে।
এ সময় আগের দিনের ঝগড়ার সমাধান করা হবে বলে অনিককে জানায় আরিফ। আরিফের কথায় অনিক সেখানে যায়। যাওয়ার পরই আগে থেকেই পরিকল্পনা সাজিয়ে রাখা আরিফ ও তার বন্ধুরা অনিককে কাঠ দিয়ে পেটাতে থাকে। একপর্যায়ে অনিকের মাথা কাঠ দিয়ে পিটিয়ে ফাটিয়ে দেয় তারা।
এ সময় অনিককে টেনেহিঁচড়ে পানিতে ফেলা হয়। সেখানেও তাকে পেটানো হয়। পেটাতে পেটাতে অনিককে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে অনিকের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
এ ঘটনায় নিহতের বাবা সাতজনের নাম উল্লেখ করে সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার পর তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বুধবার (০৫ আগস্ট) বিকেলে জানাজা শেষে অনিকের মরদেহ দাফন করা হয়।
এদিকে, সন্তান হারিয়ে বাকরুদ্ধ অনিকের মা-বাবা ও স্বজনরা। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে অনিককে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান বাবা শহিদুল্লাহ মিয়া।
তিনি বলেন, আমাকে না বলে অনিক বাড়ি থেকে বের হয় না। ঘটনার দিন বিকেল ৪টার দিকে অনিকের মোবাইলে কল দিয়ে সেতুতে যেতে বলেছিল আরিফ। অনিক যেতে দেরি হওয়ায় বাড়িতে একটা ছোট ছেলেকে পাঠায় আরিফ। অনিক সেখানে যাওয়া মাত্রই কুকুরের মতো পেটাতে পেটাতে হত্যা করা হয়। এরপর তাকে পানিতে ফেলে দেয় আরিফ ও তার বন্ধুরা।
ছেলেকে হারিয়ে সংজ্ঞাহীন অনিকের মা রোজিনা বেগম। গতকাল থেকে থেমে থেমে বিলাপ করে কেঁদেছেন আর বলেছেন, আমার আদরের ময়না ঘুমিয়ে গেছে চিরতরে। আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার করে দাও তোমরা।
অনিকের ভাই মাহিম হাসান বলেন, অনিক গোসল করছিল। ওই সময় অনিকের মোবাইলে কল দেয় আরিফ। তাকে সেতু এলাকায় যেতে বলেছিল আরিফ। অনিকের দেরি হচ্ছিল দেখে পরপর তিনবার ফোন দেয়। এরপর একটা ছেলেকে পাঠায়।
নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার দত্ত বলেন, স্কুলছাত্র অনিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করছি না। এ ঘটনায় জড়িত কেউ ছাড় পাবে না।